বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী আর নেই। শনিবার ভোর সাড়ে ৫টায় রাজধানীর বনানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে শনিবার ভোরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। শনিবারই গুলশান আজাদ মসজিদে জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশেই দাফন করা হয় এই কিংবদন্তি শিল্পীকে।
সংগীতে বহুমাত্রিক অবদান রাখা মুস্তাফা জামান আব্বাসী উপমহাদেশের এক খ্যাতনামা সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আব্বাসউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলার পল্লী গীতির পথিকৃৎ, যিনি এ দেশের পল্লীগীতিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরেন। চাচা আবদুল করিমও ছিলেন ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালির খ্যাতিমান শিল্পী। বড় ভাই মোস্তফা কামাল ছিলেন একজন আইনবিদ, আর বোন ফেরদৌসী রহমান ও কন্যা নাশিদ কামাল সংগীতজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত। তার স্ত্রী আসমা আব্বাসী ছিলেন একজন খ্যাতিমান শিক্ষক ও লেখিকা, যিনি গত বছর প্রয়াত হন।
১৯৩৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ভারতের কোচবিহারের বলামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। শৈশব কাটান কলকাতায়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও এমএ সম্পন্ন করে মার্কেটিং বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন হাভার্ড গ্রুপ থেকে। কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
লোকসংগীত গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা রাখা আব্বাসী দীর্ঘ ৫০ বছর ‘ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপ’-এর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার সংগ্রহে রয়েছে কয়েক হাজার লোকগান। ২৫টিরও বেশি দেশে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ও নজরুলগীতি পরিবেশন করে তিনি বাংলাদেশের সংগীতকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন। তিনি ইউনেসকোর বাংলাদেশ জাতীয় কমিটি অব মিউজিকের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
গবেষণা ও উপস্থাপনায়ও তার অবদান ছিল স্মরণীয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার উপস্থাপিত ‘ভরা নদীর বাঁকে’, ‘আমার ঠিকানা’, ‘আপন ভুবন’সহ একাধিক অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দিন আহমেদের ইংরেজি জীবনী লেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তিনি।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে— ‘লোকসংগীতের ইতিহাস’, ‘ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি’, ‘রুমির অলৌকিক বাগান’, উপন্যাস ‘হরিণাক্ষি’, ‘স্বপ্নরা থাকে স্বপ্নের ওধারে’ এবং একাধিক ইংরেজি জীবনীগ্রন্থ। তিনি রোটারি ক্লাবের গভর্নর হিসেবেও বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগে সক্রিয় ছিলেন।
বাংলা সংস্কৃতিতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি একুশে পদকসহ দেশ-বিদেশে নানা পুরস্কারে ভূষিত হন।
সংগীত ও সাহিত্যপ্রেমী মানুষ হারালেন এক কিংবদন্তিকে। তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলার সংস্কৃতি ইতিহাসে।