আদনান আল রাজীব পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আলী’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক অসাধারণ মাইলফলক। চলচ্চিত্রটি ২০২৫ সালের ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের নাম উজ্জ্বল করে। এটি বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র যা কানের স্বল্পদৈর্ঘ্য বিভাগে অফিশিয়াল সিলেকশনে জায়গা করে নেয়। এই নির্বাচন প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের নির্মাতারাও বিশ্বমানের গল্প বলার এবং নির্মাণশৈলীর সক্ষমতা রাখেন।
‘আলী’ চলচ্চিত্রটি মাত্র ১৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের হলেও এর নির্মাণে রয়েছে গভীর ভাবনা এবং দারুণ নির্মাণশৈলী। ২০২৪ সালের নভেম্বরে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন লোকেশনে চলচ্চিত্রটির চিত্রায়ণ সম্পন্ন হয়। পরিচালক আদনান আল রাজীব জানিয়েছেন, এই চলচ্চিত্রটি মানুষের জীবনের ভেতরকার এক অনিবার্য সত্যের আবিষ্কারে উৎসাহিত করে, কিন্তু সেটি প্রকাশ করা হয়েছে একদম সরল এবং সংবেদনশীল ভঙ্গিতে। নির্মাতা নিজেই বলেছেন যে, তিনি গল্পটি বড় ক্যানভাসে নয়, বরং নিঃশব্দ আবেগ এবং ছোট ছোট মুহূর্তের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। চলচ্চিত্রটির চরিত্র নির্মাণ এবং দৃশ্যভাষা এতটাই সংবেদনশীল ও আন্তরিক যে, তা সহজেই দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।
এই চলচ্চিত্রের নির্মাণে যুক্ত ছিল আন্তর্জাতিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ক্যাটালগ’। এটি মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য একটি সহযোগিতামূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে আছেন আদনান আল রাজীব, বাংলাদেশের প্রযোজক তানভীর হোসেন, ফিলিপাইনের নির্মাতা ক্রিস্টিন ডি লিওন এবং আরভিন বেলারমিনো। এই ধরনের আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকে আরও বৈশ্বিক পরিসরে তুলে ধরার সুযোগ করে দেয়, এবং ‘আলী’ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
২০২৫ সালের ২২ মে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘আলী’-এর বিশ্বপ্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয়। একই দিনে দুটি স্ক্রিনিং হয়, যার একটি ছিল উৎসবের অফিসিয়াল প্রিমিয়ার এবং অন্যটি ছিল প্যালাসের একটি বিশেষ প্রদর্শনী। চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের পরপরই দর্শক এবং সমালোচকদের কাছ থেকে উষ্ণ প্রশংসা পায়। পরে ‘আলী’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে ‘Special Mention’ বা বিশেষ সম্মাননা অর্জন করে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক অর্জন, কারণ এর আগে কখনো কোনো বাংলাদেশি চলচ্চিত্র এই স্বীকৃতি পায়নি। পরিচালক আদনান এই অর্জনকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের জন্য একটি ‘উৎসাহজনক বার্তা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
‘আলী’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত হওয়ার পর, বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এর জন্য বিশেষ দায়িত্ব গ্রহণ করে। চলচ্চিত্রটির নির্মাতা দলকে কান পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিমানভাড়া, থাকার খরচ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় বহন করে মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা আল আমিনকে প্যারিসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় বেসরকারি উদ্যোগে। সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন যে, এটি শুধুমাত্র একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশগ্রহণ নয়, বরং বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। তিনি আরও বলেন, “আমাদের সংস্কৃতির ইমেজ নির্ভর করে এমন যেকোনো বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পাশে থাকবে।”
এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি কেবল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিই অর্জন করেনি, বরং দেশের তরুণ নির্মাতাদের জন্য একটি নতুন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। ‘আলী’-এর কাহিনি, নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশি নির্মাতারা শুধু দেশীয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক দর্শকের মন জয় করার ক্ষমতা রাখেন। ভবিষ্যতে এই ধরনের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে বলেই ধারণা করা যায়। অনেকেই মনে করেন, ‘আলী’-এর এই অর্জন বাংলাদেশে আরও সাহসী, মৌলিক এবং আন্তর্জাতিকমানের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্দীপনা যোগাবে।
‘আলী’ শুধুমাত্র একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা। এই চলচ্চিত্রের সাফল্য প্রমাণ করে যে, সীমিত বাজেট, ছোট দৈর্ঘ্য কিংবা কম জনবল থাকলেও যদি গল্প বলার কৌশল ও নির্মাণশৈলী সঠিক হয়, তবে সেটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নিতে পারে। আদনান আল রাজীব এবং তার টিমের এই অর্জন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটি নতুন পথরেখা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।