একটি নাম, যিনি একাধারে মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপনজগতের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব—তিনি আবুল হায়াত। দীর্ঘ সাত দশকের অভিনয়জীবনে নিজের প্রতিভা, শ্রম আর নিষ্ঠার মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেলেন ‘মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা’।
রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০২৪’-এর বর্ণাঢ্য আয়োজনে এ সম্মাননা তুলে দেওয়া হয় এই বর্ষীয়ান অভিনেতার হাতে। অনুষ্ঠান উপস্থাপক আফজাল হোসেন তাঁর নাম ঘোষণা করলে উপস্থিত দর্শকরা দাঁড়িয়ে সম্মান জানান এই শিল্পীকে। বড় পর্দায় তখন চলছিল আবুল হায়াতের কর্মজীবনের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র। মঞ্চে ক্রেস্ট, উত্তরীয় ও সম্মাননাপত্র তুলে দেন অভিনেত্রী দিলারা জামান, সঙ্গে ছিলেন স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক।
১৯৪৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, ব্রিটিশ ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্ম নেওয়া আবুল হায়াত মাত্র তিন বছর বয়সে চলে আসেন চট্টগ্রামে। বাবা ছিলেন রেলওয়ের চাকরিজীবী। শৈশব-কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামের রেলওয়ে কলোনিতে। ১৯৬২ সালে ভর্তি হন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে (বর্তমান বুয়েট)। প্রকৌশলী হিসেবে জীবন শুরু করলেও অভিনয়ের প্রতি টান তাঁকে নিয়ে যায় ভিন্ন পথে। ছাত্রজীবনেই ‘এক মুঠো আকাশ’ নাটকের মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর মঞ্চজীবন। ১৯৬৮ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের ‘ইডিপাস’ দিয়ে টিভিতে তাঁর যাত্রা শুরু।
ঢাকা ওয়াসায় প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেওয়ার পরও থেমে থাকেননি তিনি। ১৯৭৮ সালে লিবিয়ায় যান আর্থিক উন্নতির আশায়। তিন বছর পর ফিরে এসে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। কিছুদিন বেসরকারি চাকরি ও কনসালট্যান্সি করলেও শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন অভিনয়ে। ১৯৯৫ সাল থেকে পূর্ণকালীন অভিনেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন।
বিটিভির স্বর্ণযুগে তাঁর নাম উঠে আসে প্রথম সারির অভিনেতাদের তালিকায়। ‘অয়োময়’, ‘বহুব্রীহি’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘আজ রবিবার’সহ অসংখ্য নাটকে তিনি হয়ে ওঠেন দর্শকের প্রিয় মুখ। নব্বই দশকে ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’সহ বহু চলচ্চিত্রেও তিনি রেখেছেন অনন্য ভূমিকা।
১৯৭০ সালে বিয়ে করেন মাহফুজা খাতুন শিরীনকে, যাঁর সঙ্গে পার করেছেন দীর্ঘ ৫৫ বছরের দাম্পত্য জীবন। সংসার, সন্তান পালন, কঠিন সময় পেরিয়ে যাওয়া—সবকিছুর জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা জানান স্ত্রীকে। বলেন, “চাকরি আর অভিনয়ে ব্যস্ত ছিলাম, কিন্তু সংসারটা সামলে রেখেছে শিরীন। এই পুরস্কার তার প্রাপ্য।”
আজ ৮০ বছর বয়সেও মাসে ১৫-১৬ দিন নিয়মিত শুটিং করেন তিনি। কাজে ডুবে থাকাতেই খুঁজে পান জীবনের আনন্দ। পুরস্কার কিংবা সম্মান তাঁর থেমে যাওয়ার কারণ নয়—তাঁর চলার পথ আরও দীর্ঘ, আরও উজ্জ্বল। এই সম্মান যেন তাঁর একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি নয়, বরং আরও এক নতুন অভিযাত্রার সূচনা।