চলচ্চিত্র এক সময় শুধু বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, বরং তা হয়ে উঠেছিল জাতির সংস্কৃতি, চিন্তাধারা ও সমাজ বাস্তবতার দর্পণ। ১৮৯০-এর দশকে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে এর সূচনা হয় আমাদের দেশে। তবে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের সূচনা ঘটে বহু পরে, ১৯৫৬ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ দিয়ে। এরপর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্প নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে। স্বাধীনতার পর এ ইন্ডাস্ট্রি রমরমা ব্যবসার মুখ দেখলেও, একটি বিষয় আজও অপরিবর্তিত—‘এক নায়কনির্ভরতা’। যুগ বদলেছে, প্রযুক্তি এগিয়েছে, কিন্তু ঢালিউডের কেন্দ্রবিন্দু এখনও একজন মাত্র নায়ককে ঘিরেই আবর্তিত হয়।
ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকাই সিনেমায় রাজত্ব শুরু করেন নায়করাজ রাজ্জাক। তিনি শুধু জনপ্রিয়ই ছিলেন না, বাণিজ্যিক সফলতার দিক থেকেও ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া ৩১টি সিনেমার মধ্যে ১১টিই ছিল তার অভিনীত, যা তার একচ্ছত্র আধিপত্যের পরিচয় দেয়। তার বিপরীতে কবরী, সূচনা, শাবানা, সুচন্দা, সুজাতা, ববিতারাও ছিলেন দর্শকপ্রিয় নায়িকা।
পরবর্তীতে সত্তরের দশকে ফারুক, বুলবুল আহমেদ, আলমগীর, উজ্জ্বল, সোহেল রানা, জাভেদের মতো নতুন মুখ এলেও, রাজ্জাকের ছায়া তারা খুব একটা অতিক্রম করতে পারেননি। আশির দশকে ইলিয়াস কাঞ্চন উঠে আসেন, যিনি পরে নিজস্ব জনপ্রিয়তা গড়েন। এরপর মান্না ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম, যিনি লম্বা সময় সফলভাবে টিকে ছিলেন। অন্যরা সময়িকভাবে আলো ছড়ালেও বেশিরভাগই হারিয়ে যান। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়ে ওঠেন শাকিব খান, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে এককভাবে ঢালিউডের প্রধান তারকায় পরিণত হয়েছেন।
নতুন অনেক নায়ক এলেও প্রযোজকদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি তারা। ফলে সিনেমা নির্মাণকারীরা বারবার শাকিব খানের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। কেন এই একনায়কতন্ত্র এখনও চলছে, তা জানতে নির্মাতাদের সঙ্গে কথা বলা হয়।
পরিচালক কাজী হায়াৎ এর মতে, সিনেমা কমে যাওয়াই এর মূল কারণ। লগ্নিকারকরা ঝুঁকি নিতে চান না, যার ফলে তারা নিরাপদ মুখের দিকেই ফিরে যান। বর্তমানে হাতে গোনা মাত্র ২০টি সিনেমা হল চালু আছে, যা সংকটের গভীরতা বোঝায়।
রায়হান রাফীর মতে, আজকের দিনে দর্শকই সিদ্ধান্ত নেয় কে জনপ্রিয় হবে। নতুন শিল্পীরা সাফল্য পেতে পারে যদি তারা ধারাবাহিকভাবে ভালো কাজ করে। তিনি নিজেই সিয়াম আহমেদ, শরিফুল রাজ ও আফরান নিশোর মতো নতুন মুখ নিয়ে কাজ করছেন এবং ভবিষ্যতে আরও করবেন বলে আশাবাদী।
পরিচালক অনন্য মামুন একে পেশাদার প্রোডাকশন হাউজের অভাব হিসেবে চিহ্নিত করেন। কলকাতা ও মুম্বাইয়ে প্রোডাকশন হাউজের মাধ্যমে নায়ক-নায়িকা তৈরি হয়, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা ভিন্ন। একসময় জাজ মাল্টিমিডিয়া একটি বড় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিল, কিন্তু তারাও এখন নিষ্ক্রিয়। নতুন শিল্পীকে সুযোগ দিতে হলে ব্যাক টু ব্যাক কাজের পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যার জন্য করপোরেট বিনিয়োগ ও পেশাদার প্রোডাকশন হাউজ অপরিহার্য।
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে চলচ্চিত্রের বাজার অনেক বিস্তৃত হলেও ঢাকাই সিনেমা এখনও ‘এক নায়ক নির্ভরতা’ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। এটি শুধু একজন তারকার জনপ্রিয়তা নয়, বরং গোটা শিল্পের কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার প্রতিফলন। সমাধান হতে পারে নতুন শিল্পীদের ধারাবাহিকভাবে সুযোগ দেওয়া, সিনেমা নির্মাণে বৈচিত্র্য আনা, এবং পেশাদার প্রোডাকশন হাউজ গড়ে তোলা। এই উদ্যোগগুলোই পারে একনায়কতন্ত্র ভেঙে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, উদ্ভাবনী ও টেকসই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির পথ তৈরি করতে। আর তবেই ঢালিউড পাবে বহু নায়কের সমন্বয়ে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।